কালিন্দী হলে কালীয় নাগ নামে এক বিষধর সাপ বাস করত। তার বিয়ে ঐ হ্রদের জল বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঐ জল পান করে সেখানকার জীবজন্তু সহ অনেকেই মারা যায়। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর গোপবালক বন্ধুদের সঙ্গে ঐ হ্রদের পাড়ে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে খেলা করছিল। কৃষ্ণের কয়েকজন তৃষ্ণার্ত বন্ধু ঐ হলের জল পান করল এবং তৎক্ষণা মারা গেল। সকলে এ দৃশ্য দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল এবং এর কারণ খুঁজতে লাগল। এমন সময় শ্রীকৃষ্ণ সেখানে এলেন।
শ্রীকৃষ্ণঃ কী হয়েছে এখানে? আমাকে বলো।
প্রথম গোপবালক বন্ধু : কেন তুমি জানো না! কালিন্দী হ্রদে একটি ভয়ংকর সাপ এসেছে। হলের সব জল বিষাক্ত করে ফেলেছে। হ্রদের অনেক মাছ মরে যাচ্ছে।
শ্ৰীকৃষ্ণঃ বলো কী।
দ্বিতীয় গোপবালক বন্ধু: শুধু কি তাই! ঐ জল পান করে আমাদের কয়েকজন বন্ধু মারা গেছে।
তৃতীয় গোপবালক বন্ধুঃ এলাকার বহু জীবজন্তুও মারা গেছে। (সবাই কান্নাকাটি করতে লাগল)
চতুর্থ গোপবালক বন্ধু : আমরা এখন পানীয় জল পাবো কোথায়?
শ্ৰীকৃষ্ণঃ চিন্তা করো না, সাপটিকে আমি এখনই তাড়িয়ে দিচ্ছি।
গোপবালক বন্ধুরা (সমস্বরেঃ) তুমি যেয়ো না বন্ধু! ও ভয়ংকর সাপ।
শ্ৰীকৃষ্ণঃ তোমরা আমার জন্য ভেবো না। ভয় পেয়ো না। আমার কিছু হবে
গোপবালকদের সাথে এলাকাবাসীরাও আশার আলো দেখতে পেল।
এলাকাবাসীকে রক্ষা করতে শ্রীকৃষ্ণ সাহসিকতার সাথে লড়াই করে সাপটিকে দুর্বল করে ফেলেন। সাপটি ছিল মূলত কালীরনাথ। শ্রীকৃষ্ণ কালীয়কে হ্রদ থেকে তাড়িয়ে দিলেন। বিষাক্ত সাপ থেকে রক্ষা পেল এলাকাবাসী। তারা প্রাণে বেঁচে গেল। সকলে শ্রীকৃষ্ণের প্রশংসা করতে লাগলেন।
নাটিকাটিতে অভিনয় করে নিশ্চয়ই তোমরা অনেক আনন্দ পেয়েছ। এখানে আমরা দেখলাম শ্রীকৃষ্ণ নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে গোপবালক বন্ধুসহ এলাকাবাসীর জীবন বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন। এবার আমরা আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে এরকম মানবিক ও নৈতিক গুণাবলির একটি ঘটনা লিখব।
আমরা সমাজে বাস করি। সমাজে ভালো-মন্দ দুই-ই থাকে। কিন্তু আমরা সবাই বুঝতে পারি না, কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ। অথচ আমাদের ভালো-মন্দ বোঝা খুবই জরুরি। কারণ ভালো কাজ না করলে। আমরা ভালো থাকি না। সমাজ ভালো থাকে না। এই ভালো-মন্দ বোঝার জন্য জ্ঞান থাকতে হবে। ভালো- মন্দ বা ভালো কাজ মন্দ কাজ বোঝার জ্ঞানকে বলা হয় নীতি। নীতির সঙ্গে যা যুক্ত হয় তা নৈতিকতা। পরমতসহিষ্ণুতা, মানবিকতা, সহমর্মিতা, দায়িত্বশীলতা এ সবই নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত। হিন্দুধর্ম গ্রন্থসমূহে নৈতিকতা সম্পর্কে অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। এর পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক অনেক উপাখ্যান আছে। এর মধ্য দিয়ে আমরা নৈতিক শিক্ষা লাভ করতে পারি। এখন আমরা মানবিকতা, সহমর্মিতা ও দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে জানব । আমরা এখানে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত দৃষ্টান্তমূলক উপাখ্যান থেকে শিক্ষা লাভ করব।
স্বামী বিবেকানন্দের মানবিকতা
বিবেকানন্দের জন্ম ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। তাঁর পিতার নাম বিশ্বনা ও মাতার নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন আমেরিকায় যান তখন তিনি ছিলেন ৩০ বছরের এক যুবক। সেই সময় আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে তিনি যোগদান করেন। এই সম্মেলনে তিনি হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। তাঁর বক্তৃতা প্রশংসিত হয় এবং তিনি শ্রেষ্ঠ। বক্তায় পরিণত হন। এই বক্তৃতা তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান ব্যক্তিতে পরিণত করে। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি। আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন। কলকাতায় তাকে বিশাল সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং দেশে-বিদেশে তাঁর জয়জয়কার পড়ে যায়। বিশ্বজোড়া তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এসব নাম ও খ্যাতির উপরে তার বড় পরিচয় তিনি ছিলেন মানবতাবাদী ও মানবদরদি। তাঁর মানবসেবার কোনো তুলনা হয় না। এখানে তার একটা দুষ্টয়ে দেওয়া হলো।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা থেকে ফিরে এসেই তিনি বহু কাজ হাতে নেন এবং পরিকল্পনা করেন অনেক কাজের। এর মধ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় সমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার জন্য বিদেশ থেকে অনেক আমন্তন আসছিল। কিন্তু কিছুদিন পর কলকাতায় দেখা দিল প্লেগ রোগের মহামারী। আমরা করোনা মহামারীর কথা জানি। করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল প্লেগ মহামারী। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন বহু লোকের মৃত্যু হতে লাগল। শোনা যায়,
কলকাতার প্রায় তিন ভাগ লোক মৃত্যুভয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বিবেকানন্দ তাঁর সমস্ত কাজ বন্ধ করে দিলেন। তাঁর একমাত্র কাজ হলো প্লেগে আক্রান্ত রোগীদের সেবা করা এবং তাদের সুস্থ করে তোলা। তিনি তাঁর অনুগামী সাধু-সন্ন্যাসীদের নিয়ে সভা করলেন। তাদের বললেন- "আমরা মরণকে ভয় করে প্রেগ রোগীদের কাছ থেকে দূরে থাকব না। তাদের ঔষধ দিব এবং চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করব।' তিনি বললেন, "প্রয়োজনে টাকার জন্য আমরা মঠের জমি বিক্রি করব। আমরা আমাদের জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি।' এই সময় রাস্তায় প্রচুর ময়লা জনে গিয়েছিল। মৃত্যুর ভয়ে ময়লা পরিষ্কার করার কাজ যাদের, সেই মেথররাও রাস্তায় নামছিল না। ফলে, ময়লা থেকে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছিল। এমনি এক অবস্থায় রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ময়লা পরিষ্কার করা খুবই দরকার ছিল। বিবেকানন্দ তাঁর সাধু-সন্ন্যাসী ভাই ও অনুগামীদের নিয়ে রাস্তায় নামলেন। নিজেরা ঝাঁটা হাতে রাস্তা পরিষ্কার করতে লাগলেন। বিবেকানন্দের শিষ্য সিস্টার নিবেদিতাও ঝাঁটা হাতে রাস্তা পরিষ্কারে নেমে ছিলেন। তাদের দেখে মেথররা রাস্তায় নামলেন। তাদের নিয়মিত কাজ রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার করা শুরু করলেন। বিবেকানন্দ প্রচারপত্রে জানালেন এবং সবাইকে বললেন, 'মৃত্যু সকলেরই হবে। কাপুরুষরাই বারবার মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে। যা আমাদের অভয় দিচ্ছেন। ভয় নাই, ভয় নাই।” বিবেকানন্দ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে প্লেগ রোগীদের কাছে পেলেন। তাদের অক্লান্ত চেষ্টায় অনেক প্রেগ রোগী সুস্থ হলো। অনেকে মৃত্যুপথ থেকে ফিরে এল। তারপর একসময় কলকাতা প্লেগ রোগ থেকে মুক্ত হলো।
বিবেকানন্দের এই মানব সেবার কোনো তুলনা নেই। তিনি অতি সাধারণ মানুষের সেবা করেছেন। সারা জীবন তিনি সাধারণ মানুষের কথা ভেবেছেন। তাঁর কাছে মানবসেবাই ছিল ঈশ্বরসেবা, ভগবানের সেবা। ভগবানের এক নাম নারায়ণ। তিনি উপাসা নারায়ণ থেকে মনুষ্য নারায়ণকেই বড় উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এটা মোটেই সহজ কথা নয়। ভগবানের জায়গায় সাধারণ মানুষকে স্থান দিয়ে তাদের সেবা করা সহজ নয়। বিবেকানন্দ বলেছেন, 'আমার সব থেকে বড় উপাসা পাপী নারায়ণ, তাপী নারায়ণ, সর্বজাতির দরিদ্র নারায়ণ।"
দায়িত্বশীলতা
আমরা একজন অসাধারণ মানুষের কথা জানব। জানব তাঁর দায়িত্বশীলতার কথা। দায়িত্ব, দায়িত্বীলতা সম্পর্কে আমরা জানি। কারও ওপর কিছু করার ভার দেওয়া হয়। এই ভার নেয়াটাই দায়িত্ব। আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব আছে। সে দায়িত্ব পালন করা উচিত। এই দায়িত্ব পালন করার বিষয়টি হলো দায়িত্বশীলতা। আমরা এখন একজন অসাধারণ দায়িত্বশীল মানুষের কথা জানব। তিনি ভরত।
আমরা রামায়ণের কথা জানি। রামায়ণের একজন রাজার নাম দশরথ। তিনি অযোধ্যার রাজা ছিলেন। দশরথের তিন স্ত্রী। কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা। তিন স্ত্রীর চার ছেলে। কৌশল্যার ছেলে রামচন্দ্র। কৈকেয়ীর ছেলে ভরত। আর সুমিত্রার যমজ ছেলে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন।
রাম ভাইদের মধ্যে বড়। দশরথ বড় ছেলে রামচন্দ্রকে সিংহাসনে বসানোর আয়োজন করলেন। কিন্তু এতে কৈকেয়ী বাধা দিলেন। তিনি বললেন, তার ছেলে ভরতকে সিংহাসনে বসাতে হবে। এক সময় নশর কৈকেয়ীকে দুটি বর দিতে চেয়েছিলেন। কৈকেয়ী সেই দুটি বর চাইলেন। এক বরে ভরত রাজা হবে। আরেক করে রামচন্দ্র চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে যাবেন। রামচন্দ্র পিতৃসত্য পালনে বনে চলে গেলেন। রামচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী সীতা গেলেন। ভাই লক্ষ্মণও গেলেন। ছেলের শোকে-দুঃখে রাজা দশরথের মৃত্যু হলো। এসব ঘটনার কিছুই জানতেন না ভরত। তিনি তখন তাঁর মামাবাড়িতে ছিলেন। শত্রুরও ছিলেন ভরতের সঙ্গে।
ভরতকে সব সংবাদ দেয়া হলো। তিনি ফিরে এলেন অযোধ্যায়। সব কথা শুনলেন। মায়ের ওপর তাঁর খুব রাগ হলো। খুব কষ্ট পেলেন। তিনি রাজা হতে চাইলেন না। বড়ো ভাই রামচন্দ্রকে ফিরিয়ে আনতে বনে গেলেন। কিন্তু রামচন্দ্র শত অনুরোধেও ফিরলেন না। তখন ভরত রামচন্দ্রের কাছে তার দুটি পাদুকা চাইলেন। তিনি বললেন, এই পাদুকা সিংহাসনে থাকবে। রামচন্দ্রের পক্ষে সেবক হিসেবে তিনি রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন।
ভরত চৌদ্দ বছর রাজা ছিলেন। কিন্তু তিনি নামেই রাজা ছিলেন। রামচন্দ্রই ছিলেন প্রকৃত রাজা। রাম পক্ষে তিনি রাজার দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। চৌদ্দ বছর ভরত কোনো রাজভোগ গ্রহণ করেননি। সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করেছেন। রামচন্দ্র বনবাসে ছিলেন। বনে বনে ঘুরে কষ্ট পেয়েছেন। ভরত সেকথা স্মরণ করেছেন। রাজবাড়িতে রাজা হয়েও তিনি বনবাসীর মতো থেকেছেন। কিন্তু এই চৌদ্দ বছর তিনি রাজ্যের অনেক উন্নতি করেছেন। রাজ্যের প্রজারা সুখী ছিল। চৌদ্দ বছর পর রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে এলেন। ভরত রামচন্দ্রকে তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন। বড় ভাইয়ের প্রতি ভরতের এই শ্রদ্ধা-ভালোবাসার তুলনা হয় না। তুলনা নেই তাঁর দায়িত্বশীলতারও।
দায়িত্বপালন ও দায়িত্বশীলতার জন্য ভরত একজন আদর্শ মানুষ। তিনি অসাধারণ মানুষ। দায়িত্বশীলতার জন্য ভরত চিরস্মরণীয়। চির অনুসরণীয়। ভরতের আদর্শকে আমরা স্মরণ করব। ভরতকে আমরা অনুসরণ